আশুরার ফজিলত ও তাৎপর্য
🌙 আশুরার ফজিলত ও তাৎপর্য (১০ই মুহাররম)
🔰 ভূমিকা:
আশুরা একটি ইসলামের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এটি হিজরি বছরের প্রথম মাস মুহাররমের ১০ তারিখে পড়ে। ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও শিক্ষার স্মারক হিসেবে বিবেচিত। এ দিনটি যেমন রহমতের, তেমনি আত্মত্যাগ, শিক্ষা ও ইবাদতের দিন।
📜 আশুরা শব্দের অর্থ:
"আশুরা" শব্দটি আরবি "আশারা" (عشرة) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দশ’। হিজরি ক্যালেন্ডারের মুহাররম মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে এই দিনটি আলাদা মর্যাদা পেয়েছে।
🌟 আশুরার ফজিলতসমূহ:
১️⃣ পেছনের একবছরের গুনাহ মাফ হয়
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
"আশুরার রোযা বিগত বছরের গুনাহসমূহ মোচনের উপায়।"
(সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
এটি ছোট ছোট গুনাহের জন্য প্রযোজ্য, যেহেতু বড় গুনাহ মাফের জন্য তাওবা আবশ্যক।
২️⃣ বহু নবীর জীবনে আশুরা গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল
হাদীস ও বর্ণনা থেকে জানা যায় যে এই দিনে বহু গুরুত্বপূর্ণ নবী ও উম্মতের জীবনে ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল:
✅ হযরত নুহ (আ.) - তাঁর নৌকা জুদি পাহাড়ে থেমেছিল।
✅ হযরত মূসা (আ.) - বনী ইসরাইলকে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্ত করেছিলেন।
✅ হযরত ইব্রাহিম (আ.) - আগুন থেকে মুক্তি পান।
✅ হযরত আদম (আ.) - তাঁর তাওবা কবুল হয়।
✅ হযরত আইয়ুব (আ.) - রোগ থেকে মুক্ত হন।
এই কারণেই রাসুল (সা.) আশুরার রোযা রেখেছিলেন এবং সাহাবীদেরকেও রাখতে উৎসাহিত করেছিলেন।
3️⃣ রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে রোযা রাখতেন
যখন রাসুলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরত করেন, তিনি দেখতে পান যে ইয়াহুদিরা আশুরার দিন রোযা রাখে। কারণ, এই দিনে মূসা (আ.) ও তাঁর জাতি ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি পেয়েছিল। তখন তিনি বলেন:
"আমরা মূসার চেয়ে তার অনুসরণে অধিক হকদার।"
(সহিহ বুখারী: ২০০৪)
তিনি রোযা রাখেন এবং সাহাবীদেরও রোযা রাখতে বলেন।
4️⃣ রোযা রাখার সুন্নত পদ্ধতি
রাসুল (সা.) চেয়েছিলেন ইহুদিদের রীতি অনুসরণ না করে আলাদা রীতি পালন করতে। তাই তিনি বলেন:
"তোমরা আশুরার রোযা রাখো এবং একদিন আগে বা পরে রোযা রাখো।"
(মুসনাদ আহমদ)
✅ তাই সুন্নত হলো:
- ৯ ও ১০ মুহাররম
অথবা - ১০ ও ১১ মুহাররম রোযা রাখা।
5️⃣ কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা
৬১ হিজরির ১০ মুহাররম, আশুরার দিন কারবালার প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) শহীদ হন। তাঁর আত্মত্যাগ সত্য, ন্যায় ও ইসলামের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছে।
তাঁর শাহাদাত মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা দেয়—ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, অন্যায়ের সামনে মাথা নত করা যাবে না।
6️⃣ ইবাদত, দান-খয়রাত ও নেক আমলের দিন
আশুরা শুধু রোযা রাখার দিন নয়, বরং এটি এমন একটি দিন, যেদিন বেশি বেশি নেক আমল করা উচিৎ। যেমন:
- ❖ বেশি বেশি ইস্তেগফার (তাওবা করা)
- ❖ কুরআন তেলাওয়াত করা
- ❖ নফল নামাজ আদায় করা
- ❖ দান-খয়রাত করা
- ❖ গরিব-দুস্থদের খাওয়ানো
- ❖ পরিবারের খরচ কিছুটা বাড়ানো (হাদিসে রয়েছে, এতে বরকত হয়)
🔎 আশুরার শিক্ষা:
- তাওবার গুরুত্ব – হযরত আদম (আ.)-এর তাওবা এই দিনে কবুল হয়েছিল।
- জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – ইমাম হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা।
- ধৈর্য ও ত্যাগের শিক্ষা – নবীদের জীবনের ঘটনাগুলো আমাদের শেখায় ধৈর্য, আত্মত্যাগ ও আল্লাহর ওপর ভরসা।
❌ ভুল ধারণা ও বিদআত:
আশুরার দিনে কিছু ভুল ও ভিত্তিহীন প্রথা সমাজে দেখা যায়, যেমন:
- নিজেকে আঘাত করা, রক্ত ঝরানো
- বিশেষ খাবার রান্না করা (বিশেষ মোসাল্লা বা রেওয়াজি খাবার)
- কবর জিয়ারত বা নির্দিষ্ট আচার পালন করা
- শোক পালন করে মাতম করা
⚠️ এগুলো ইসলামে অনুমোদিত নয়। আশুরা স্মরণীয় হলেও ইসলামের নির্দিষ্ট সুন্নত অনুসরণ করাই উচিত।
🕌 উপসংহার:
আশুরার দিন আমাদের জন্য একটি মহৎ সুযোগ—আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার, আত্মশুদ্ধি অর্জনের ও নতুনভাবে ভালো মানুষ হয়ে ওঠার। এ দিন আমাদের শেখায়:
- সত্যের পক্ষে থাকা,
- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা,
- ও নিজের ভুল শোধরানোর মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা।
✨ আপনার জন্য দোয়া:
আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদের আশুরার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে এবং যথাযথভাবে পালন করতে তাওফিক দেন।
আমীন।
No comments